নিজস্ব প্রতিবেদক ঃ
কর্ণফুলী টানেল কি ?
বাংলাদেশের বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ওয়ান সিটি টু টাউন করার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। বিশাল পরিকল্পনার অংশ হিসেবে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে দেশের ইতিহাসে প্রথম টানেল নির্মাণাধীন রয়েছে। এই টানেল চট্টগ্রাম নগরীর মূল শহরের সঙ্গে কর্ণফুলী নদীর অপর পার আনোয়ারা উপজেলাকে সরাসরি যুক্ত করবে এবং দুপারে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ নিশ্চিত করবে। আর এই টানেল ঘিরে পিছিয়ে থাকা আনোয়ারা এলাকায় শিল্পায়নে বিপ্লব হবে। বর্তমানে আনোয়ারা প্রান্তে চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং কোরিয়ান ইপিজেড ঘিরে বিশাল বিনিয়োগ হবে।
অবকাঠামো –
পতেঙ্গা ও আনোয়ারায় কর্ণফুলী নদীর তলদেশে সড়ক নির্মাণের কাজ চলছে পুরোদমে। মূল টানেল ২টি টিউব সম্বলিত ও ৩.৪ কি.মি: দীর্ঘ ৪ লেনের টানেল। পাশাপাশি টানেলের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫.৩৫ কি:মি: এপ্রোচ রোড এবং ৭২৭ মিটার ওভার ব্রিজ (Viaduct) ও নির্মাণাধীন রয়েছে।
কাজের অগ্রগতি –
সর্বশেষ কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে যদি বলি তাহলে পুরো টানেল প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৬৫%। এছাড়া আনোয়ারা প্রান্তে ৭২৭ মিটার ভায়াডাক্ট নির্মাণের অগ্রগতি প্রায় ৫৫ শতাংশ। এর মধ্যে ১২১টি কাস্ট ইন সিটু বোরড পাইল, ১০৩টি কংক্রিট পিয়ার ও ৪৬টি কলার বিমের শতভাগ কাজ, ৪৬টি পিয়ার ক্যাপের মধ্যে ৪৬টির শতভাগ কাজ এবং ২০৩টি প্রি-ফেব্রিকেটেড বক্স গার্ডারের মধ্যে ১২২টির ৫৮ দশমিক ৬২ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। টানেলের জন্য ১৯ হাজার ৬১৬টি সেগমেন্টের নির্মাণ কাজ চলছে চীনের জিনজিয়াং শহরে। অলরেডি প্রায় সব সেগমেন্টের নির্মাণ ও শেষ হয়েছে। যার মধ্যে ১৫ হাজার ৭৮৪টি সেগমেন্ট প্রকল্প এলাকায় পৌঁছেছে এবং নয় হাজার ৭৮৪+ সেগমেন্ট টানেলের অভ্যন্তরে স্থাপন করা হয়েছে।
প্রকল্প বাজেট –
কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পটি বাংলাদেশ ও চীন সরকারের (জি টু জি) যৌথ অর্থায়নে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পটির মোট ব্যয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে চার হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ টাকা আর চীন সরকারের ঋণ পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা। China Communications Construction Company CCCC মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কর্ণফুলী টানেল বাস্তবায়ন করতেছে
কিভাবে টানেলটি আনোয়ারাবাসীর স্বপ্ন ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের উন্নয়ন করবে –
চট্টগ্রাম শহরের আয়তন ১৬৮ বর্গকিলোমিটার। ভারী ও মাঝারি শিল্প-কারখানার আবাস্থল চট্টগ্রাম । এখানে দেশের প্রথম ইপিজেডসহ আছে বেশকটি শিল্পাঞ্চল। চট্টগ্রাম শহর কর্ণফুলী নদীর উত্তরপাড়ে অবস্থিত। কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণপাড়ে রয়েছে পাহাড়ি ভূমি, এর ভেতর রয়েছে কোরিয়ান ইপিজেড, ২ টি সারকারখানা এর পাশাপাশি বিচ্ছিন্নভাবে কিছু শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে।আরো নির্মাণাধীন রয়েছে “চায়নিজ ইন্ডাস্ট্রিয়েল এন্ড ইকোনমিক জোন। বলতে গেলে কর্ণফুলী নদীর উত্তরপাড়ে শহর, দক্ষিণপাড়ে পাহাড়-জঙ্গল!!! কিন্ত পাহাড় জঙ্গল সাবাড় করে গড়ে উঠেছে অনেক ভারি শিল্পকারখানা যা চট্টগ্রাম শহরের অন্তর্ভুক্ত নই! কেন নই? কারন দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐ অংশে যেতে হলে ২০/২৫ কিলোমিটার ঘুরে যেতে হয়। অথচ দুই প্রান্তের দুরত্ব মাত্র ২/১ কিলোমিটার!! কিন্ত নদীর মোহনায় কোন সংযোগ না থাকায় শহর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল ভারি শিল্পকারখানা অধ্যুষিত নদীর দক্ষিণ পাড়। কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ হয়ে গেলে চট্টগ্রাম শহরের অন্তর্ভুক্ত হবে বিরাট একটা ভারি শিল্পকারখানা বেষ্টিত জায়গা, আয়তনে এই জায়গা সিলেট শহরের চেয়ে ও বড় হবে!! ভবিষ্যতে ঢাকার মতো গঠন করা হতে পারে “চট্টগ্রাম দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন”! কোরিয়ার এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন বা কোরিয়ান ইপিজেট, “চায়নিজ ইন্ডাস্ট্রিয়েল এন্ড ইকোনমিক জোন, সার কারখানা সহ বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে উঠা বেশ কিছু ভারি-মাঝারি শিল্প-কারখানার অসীম সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে কর্ণফুলী টানেল। একমাত্র একটি টানেলের জন্য এখনো নদীর দক্ষিণ পাড়ে চট্টগ্রাম শহর বর্ধন করা যায় নি
কেন টানেল নিমাণ –
বর্তমানে কর্ণফুলী নদীর ওপর ২/৩ টি ব্রিজ আছে। এ ব্রিজ গুলো দিয়ে চট্টগ্রামের দক্ষিণ অংশের সঙ্গে মূল শহরের কোনো সংযোগ নেই। অনেকে বলে কর্ণফুলী নদীর উপর তো সুন্দর একটা ব্রীজ (শাহ আমানত সেতু) আছে তবু ও কেন এত টাকা ব্যয়ে টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে? আবার অনেকে বলে টানেলের পরিবর্তে ঐ জায়গায় ব্রীজ কেন করা হয় নি কেন? প্রথমটার উত্তর হল কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণপাড়ে যেখানে ভারি-মাঝারি শিল্পকারখানা রয়েছে, এই জায়গা থেকে শাহ আমানত সেতুর দুরত্ব ১৭+ কিলোমিটার। আর সেতু দিয়ে ঘুরে বন্দরের দুরত্ব দাড়াবে ২০/২৫ কিলোমিটার। অথচ আনোয়ারা থেকে বন্দরের সুজাসুজি দুরত্ব মাত্র ২/১ কিলোমিটার!! এত কিলোমিটার ঘুরে দক্ষিণপাড়ে তৈরি পণ্য বন্দরে আনা-নেওয়া ব্যয়বহুল। তাছাড়া এত কিলোমিটার ঘুরে এসে দক্ষিণপাড়ে শিল্পকারখানা স্থাপন করা ও কষ্টসাধ্য ব্যপার। মূল শহরের সাথেও যুক্ত বরা যাচ্ছে না ডিরেক্ট যোগাযোগ না থাকার কারনে।
আবার অনেকে বলে টানেলের পরিবর্তে ঐ জায়গায় ব্রীজ কেন করা হয় নি কেন? এই প্রশ্নকারিদের আগে চট্টগ্রাম শহর ও ম্যাপ সম্পকে জানা দরকার। যে স্থানে টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে সেটা হল কর্ণফুলী নদীর মোহনা!! আর কর্ণফুলী নদীর মোহনা মানে চট্টগ্রাম বন্দরের চ্যানেলের প্রবেশমুখ। চ্যানেলের প্রবেশমুখে ব্রীজ নির্মাণ করলে বন্দরের বড় বড় জাহাজ গুলো কিভাবে প্রবেশ করবে?? আর সেতু যদি বিশাল উচ্চতা বিশিষ্ঠও নির্মাণ করা হলে বন্দর চ্যানেলে পলি জমে বন্দর অচল হয়ে যাবে। অর্থাৎ ব্রীজ নির্মাণ কিছুতেই সম্ভব নই। তাই কর্ণফুলী টানেল নিমাণ করা হচ্ছে।
টানেল নির্মাণের ফলে কি কি উন্নয়ন হবে –
– চট্টগ্রাম শহরে নিরবচ্ছিন্ন ও যুগোপোযুগী সড়ক যোগাযোগ ব্যাবস্থা গড়ে তোলা এবং বিদ্যমান সড়ক যোগাযোগ ব্যাবস্থার আধুনিকায়ন হবে। চীনের সাংহাই শহরের ন্যয় চট্রগ্রাম শহরকে “One City Two Town” মডেল এ গড়ে উঠবে।
– কর্ণফুলী নদীর পূর্ব তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা শহরের সাথে ডাউন টাউনকে যুক্ত করা এবং উন্নয়ন কাজ ত্বরান্বিত হবে।
– চট্টগ্রাম পোর্টের বিদ্যমান সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি এবং নির্মাণাধীন মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের সাথে সহজে কানেক্ট হবে চট্টগ্রাম বন্দর। দক্ষিণ প্রান্তের শিল্প-কারখানার কাঁচামাল ও প্রস্তুত মালামাল চট্টগ্রাম বন্দর, বিমানবন্দর ও দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পরিবহন সহজ হবে।
– ঢাকা থেকে কক্সবাজার যেতে ৫০ কিলোমিটার দূরত্ব কমে আসবে এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণের লোকজন টানেলটি ব্যবহার করে সহজে চট্টগ্রাম শহরে আসা সহজ হবে।
– ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এর মধ্যে নতুন একটি সড়ক যোগাযোগ ব্যাবস্থা গড়ে উঠবে। প্রস্তাবিত মিরসরাই-টেকনাফ মেরিনড্রাইভ সড়কের গুরুত্বপূর্ণ কানেক্টর হবে। এবং এশিয়ান হাইওয়ের সাথে সংযোগ স্থাপন হবে।
– সার্বিকভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজিকরণ, আধুনিকায়ন, শিল্পকারখানার বিকাশ সাধন এবং পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের ফলে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্প নির্মিত হলে বেকারত্ব দূরীকরণসহ দেশের অর্থনৈতিকউন্নয়নে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।
– দক্ষিণপাড়ে শিল্প-কারখানার বিকাশ সাধন এবং পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে কর্ণফুলী টানেল বেকারত্ব দূরীকরণসহ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। ভ্রমণের সময় ও খরচ হ্রাস পাবে এবং কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণপ্রান্তের সঙ্গে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের ফলে পূর্বপ্রান্তে পর্যটন শিল্প বিকশিত হবে।
– ফিন্যান্সিয়াল এবং ইকোনমিক আইআরআর-এর পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ৬.১৯ শতাংশ ও ১২.৪৯ শতাংশ। এছাড়া ফিন্যান্সিয়াল ও ইকোনমিক ‘বেনিফিট কস্ট রেশিও’র (বিসিআর) পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ১.০৫ ও ১.৫০ শতাংশ। ফলে কর্ণফুলী টানেল জিডিপিতে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তথ্য বিভিন্ন ব্যক্তি ও মাধ্যম থেকে সংগৃহীত , ছবি – সারা আনোয়ারা